জনতার ইশতেহার সম্পর্কে

“জনতার ইশতেহার” হলো বাংলাদেশের প্রথম জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের উদ্যোগ। এখানে নাগরিকরা শুধুমাত্র ভোটার নয়—বরং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার সহ-লেখক হিসেবে সরাসরি অংশ নেবে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নাগরিকদের মতামত, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর টুলের সমন্বয়ে SMART (Specific, Measurable, Achievable, Relevant, Time-bound) কাঠামোয় একটি অংশগ্রহণমূলক “জনতার ইশতেহার” প্রণয়নই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।

এই প্রক্রিয়া চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে—
Public Participation Public Validation Online Manifesto Promise Tracker
যা নাগরিক অংশগ্রহণ, প্রযুক্তি ও তথ্যের সমন্বয়ে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন এবং নির্বাচন-পরবর্তী জবাবদিহিতা আরও স্বচ্ছ, তথ্যনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ইশতেহার প্রণয়ন প্রক্রিয়া মূলত বুদ্ধিজীবী ও দলীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে; সাধারণ জনগণের মতামত ও প্রত্যাশা সেখানে খুব কমই প্রতিফলিত হয়। এই কারণে ইশতেহার অনেক সময় জনগণের বাস্তব জীবন, স্থানীয় চ্যালেঞ্জ ও অগ্রাধিকারের সঙ্গে সংযোগ হারায়। ফলস্বরূপ, তা জনআকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন না হয়ে কেবল একটি নীতিপত্রে পরিণত হয়, যা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকর ফলাফল নিশ্চিত করতে পারে না।

এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে প্রয়োজন এমন একটি ইশতেহার প্রণয়ন প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণের সরাসরি মতামত, স্থানীয় সমস্যা ও অগ্রাধিকার তথ্যভিত্তিকভাবে প্রতিফলিত হবে। একটি জবাবদিহিমূলক ও পরিমাপযোগ্য (Measurable) কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ইশতেহারের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি নির্ধারণ করলে তা কেবল রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নয়—বরং বাস্তবায়নযোগ্য উন্নয়ন পরিকল্পনাতে রূপ নেবে।

নির্বাচনের পর প্রতিশ্রুতিগুলোর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ডিজিটাল “Promise Tracker” চালু করা যেতে পারে, যেখানে নাগরিকরা সহজেই দেখতে পারবেন—কোন অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়েছে, কোনটি এখনও চলমান, আর কোনটির অগ্রগতি থেমে আছে বা মন্থর। এটি কেবল স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নাগরিক আস্থা, অংশীদারিত্ব ও নীতি-নির্ভর রাজনীতির নতুন ধারা তৈরি করবে।

“জনতার ইশতেহার” একটি অংশগ্রহণমূলক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দেশের ভোটাররা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহ-লেখক হয়ে নিজ নিজ চাহিদা ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে ইশতেহার তৈরিতে অংশ নেবে।

ইশতেহারটির দুটি অংশ: 

  1. জাতীয় সমন্বিত ইশতেহার: এই অংশটি হবে “মৌলিক নীতি ও রূপরেখা”, যা পুরো দেশের জন্য অভিন্ন। এর লক্ষ্য হলো জাতীয় স্তরে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতসমূহ—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সরকারি সেবা, বাণিজ্য, পরিবেশ, প্রযুক্তি ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে, সংস্কার-অগ্রাধিকার নির্ধারণে জনগণের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় ইশতেহারটি হবে এমন এক নীতি-দলিল, যেখানে সমগ্র দেশের মানুষের চিন্তা, চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার সুষম প্রতিফলন ঘটবে।
  2. প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জন্য আলাদা ইশতেহার: এই স্তরটি মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও স্থানভেদে অনন্য চাহিদার ভিত্তিতে প্রণীত হবে—যাতে একই নীতির একরূপ প্রয়োগের বদলে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জন্য উপযোগী ‘স্থানীয় সমাধান’ (Context-Specific Local Solutions) উপস্থাপন করা যায়।

জন-অংশগ্রহণ, জবাবদিহি ও প্রযুক্তিনির্ভর রাজনীতির এক নতুন মডেল

  1. অংশগ্রহণমূলক ইশতেহার প্রণয়ন: দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, উদ্যোক্তা, নারী, সংখ্যালঘু, প্রবাসী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সবার মতামত গ্রহণের মাধ্যমে একটি সত্যিকারের জন-অংশগ্রহণমূলক ইশতেহার তৈরি করা। শহর-গ্রাম ও অনলাইন-অফলাইন উভয় মাধ্যমে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে জনগণকে নীতি প্রণয়নের সহ-রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
  2. জাতীয় ও স্থানীয় ইশতেহারের সমন্বয়: প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার বাস্তব সমস্যা, অগ্রাধিকার ও সম্ভাবনা “ন্যাশনাল-প্লাস-লোকাল” মডেলে উপস্থাপন করা হবে। এতে জাতীয় নীতির সঙ্গে স্থানীয় বাস্তবতার সংযোগ স্থাপন হবে এবং জনগণের অংশগ্রহণ আরও দৃঢ় হবে।
  3. Promise Tracker: জবাবদিহির ডিজিটাল মাধ্যম: নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিটি অঙ্গীকারের অগ্রগতি জনগণের জন্য উন্মুক্ত ডিজিটাল “Promise Tracker”-এ প্রদর্শন করা হবে, যাতে নাগরিকরা দেখতে পারেন কোন প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই উদ্যোগ রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে।
  4. ডেটা-চালিত ও রিয়েল-টাইম নীতিনির্ধারণ: স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পরিবহন, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা, পরিবেশ ও অর্থনীতি, প্রতিটি খাতের অগ্রাধিকার নির্ধারণে তথ্যভিত্তিক ও রিয়েল-টাইম ডেটা-ড্যাশবোর্ড ব্যবহার করা। এতে সিদ্ধান্ত হবে বাস্তবসম্মত, দ্রুত ও নাগরিক চাহিদাভিত্তিক।
  5. রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা বৃদ্ধি ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা: গণতন্ত্র টেকসই করতে হলে রাজনীতিকে কেবল প্রতিশ্রুতির নয়, বরং ফলাফলের রাজনীতিতে রূপান্তর করা জরুরি। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিয়মিতভাবে তাদের প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি, অর্জন ও সীমাবদ্ধতা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা। এই প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা জনগণের আস্থা পুনর্গঠন করবে, রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নৈতিক দায়বদ্ধতা বাড়াবে এবং রাজনীতিকে করবে আরও অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক।
  6. তরুণ ও প্রথমবারের ভোটারদের সম্পৃক্তকরণ: “আগামী বাংলাদেশ তোমাদেরই”—এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তরুণ ও প্রথমবারের ভোটারদের সরাসরি ইশতেহার প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা। “তোমরা কী চাও, সেটা বলো” এই আহ্বানের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মতামত, মূল্যবোধ ও উদ্ভাবনী চিন্তা জাতীয় নীতিতে প্রতিফলিত করার সুযোগ তৈরি করা। এতে তরুণদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, অংশীদারিত্ব ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে।

১।পাবলিক পার্টিসিপেশন (জনগণের অংশগ্রহণ)

জনতার ইশতেহারের মূল ভিত্তি হলো জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ। নাগরিকরা ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ, সামাজিক মাধ্যম বা মাঠপর্যায়ের প্রচারণার মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্যসহ নানা বিষয়ে মতামত দিতে পারবেন। সংগৃহীত মতামত স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ ও র‌্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে, যাতে জনপ্রিয় ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাবগুলোই অগ্রাধিকার পায়।
ফলাফল: ইশতেহার হবে এমন কিছু যা মানুষ নিজের বলে অনুভব করবে — “এখানে আমারও একটি স্বপ্ন আছে।”

২। পাবলিক ভ্যালিডেশন (জন যাচাই)

এ স্তম্ভের লক্ষ্য হলো নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে ইশতেহারের খসড়া প্রস্তুত হবে, যা ১০ দিনের জন্য অনলাইনে 👍/👎 ভোটে যাচাই করা যাবে। পাশাপাশি প্রান্তিক ও গ্রামীণ নাগরিকদের জন্য থাকবে সরাসরি ভোট দেওয়ার ভ্যালিডেশন বুথ।
ফলাফল: ইশতেহার হবে জনগণের নিজের সিদ্ধান্ত—একটি সত্যিকারের জনতার ইশতেহার।

৩। অনলাইন ইশতেহার (Online Manifesto)

এখানে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রয়োজন, সমস্যা ও জনগণের মতামত একত্রে বিশ্লেষণ করে তৈরি হবে একটি জাতীয় ইশতেহার, পাশাপাশি ৩০০ আসনভিত্তিক স্থানীয় মাইক্রো ইশতেহার। জাতীয় ও স্থানীয় দুই স্তরের তথ্য একত্রে অনলাইনে দেখা যাবে, যা নাগরিকদের অংশগ্রহণকে জাতীয় নীতির সঙ্গে যুক্ত করবে।
ফলাফল: একটি ইশতেহার, যেখানে জাতীয় লক্ষ্য ও স্থানীয় বাস্তবতা একসাথে যুক্ত—“One Nation, 300 Voices.”

৪। অনলাইন প্রমিজ ট্র্যাকার (Promise Tracker)

নির্বাচনের পর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তব অগ্রগতি রিয়েল-টাইমে পর্যবেক্ষণের জন্য অনলাইন ড্যাশবোর্ডে থাকবে প্রমিজ ট্র্যাকার। প্রতিটি প্রতিশ্রুতি দেখানো হবে নির্দিষ্ট স্ট্যাটাসে — ✅ বাস্তবায়িত, 🕓 চলমান, ⏸️ স্থবির, ⚠️ বাধাগ্রস্ত, ❌ অসম্পন্ন। এই ডেটা-চালিত ভিজ্যুয়াল ট্র্যাকার নাগরিকদের সহজেই জানাবে কোন প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে, আর কোনটি হয়নি।
ফলাফল: স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও তথ্যভিত্তিক রাজনীতির নতুন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে।

১। Belongingness সৃষ্টি: জনগণের সঙ্গে আবেগগত সংযোগ তৈরি

  • জনগণ যখন ইশতেহার তৈরিতে অংশ নেবে, তখন তারা দলের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবে।
  • এই “sense of belongingness” দলের প্রতি আস্থা ও আবেগের বন্ধন তৈরি করবে।
  • এতে রাজনৈতিক বিমুখ জনগোষ্ঠীও দলের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবে

২। মতামতের স্বীকৃতি

  • জনগণের মতামত নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করলে দলটি “listening party” হিসেবে পরিচিতি পাবে।
  • এতে জনগণ মনে করবে—দল শুধু প্রতিশ্রুতি দেয় না, বরং তাদের কথাও শোনে ও গুরুত্ব দেয়। এর ফলে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা ও জনআস্থা বহুগুণে বাড়বে।

৩। রাজনৈতিক বিমুখ জনগোষ্ঠিকে আগ্রহী করা

  • অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে তরুণ, নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে বিমুখ নাগরিকরা আগ্রহী হবে।
  • এতে দল নতুন ভোটার বেইস তৈরি করতে পারবে এবং ভোটে বাড়তি সুবিধা পাবে।
  • এই প্রক্রিয়া দলকে “inclusive and modern” ভাবমূর্তি দেবে, যা তরুণ ভোটারদের কাছে আকর্ষণীয় হবে।

৪। Ownership-চালিত ভোট

  • যারা ইশতেহার তৈরিতে অংশ নেবে, তারা ভোট দেবে মালিকানার অনুভূতি থেকে।
  • ভোট আর কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—বরং “আমার চিন্তা বাস্তবায়ন” এর অনুভূতি থেকে আসবে।
  • এতে ভোট হবে সচেতন, দায়বদ্ধ ও দীর্ঘমেয়াদি সমর্থনভিত্তিক।

 

এই উদ‍্যোগ বাস্তবায়িত হলে  প্রথমবারের মতো ভোটারদের সহ–লেখক বানিয়ে “জনতার ইশতেহার” প্রকাশ করা সম্ভব হবে। যেখানে প্রতিটি সমস্যা থাকবে ডেটা-সমর্থিত ও বাস্তব পরিসংখ্যান-নির্ভর, প্রতিটি অঙ্গীকার হবে পরিমাপযোগ্য (KPI-সহ), আর প্রতিটি অগ্রগতি দেখা যাবে লাইভ ট্র্যাকার-এ, সবার নজরে স্বচ্ছ। এ-ভাবে রাজনৈতিক দলসমূহ যুগান্তকারী People-Powered, Tech-driven Manifesto-র মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অংশ-গ্রহণ, জবাবদিহি ও বিশ্বাসযোগ্যতার নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারবে।  “জনতার ইশতেহার” তাই শুধু একটি ম্যানিফেস্টো নয়—এটি গণতন্ত্র, প্রযুক্তি ও জবাবদিহির সম্মিলিত ব্লুপ্রিন্ট, যা প্রতিটি নাগরিককে নতুন বাংলাদেশের সহ-আর্কিটেক্ট করে করে তুলবে।